উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও আরও কিছু রোগ আছে-যার জন্য রোগীর মধ্যে তেমন কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না। তেমনই একটি রোগ ডিসলিপিডেমিয়া। আমাদের দেহের রক্তের মধ্যে অনেক উপাদান রয়েছে যার মধ্যে লিপিড (চর্বি) একটি অন্যতম উপাদান এবং এটি শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক। লিপিডের মৌলিক উপাদান ৪টি। কলেস্টেরল, হাইডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন, লোডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন এবং ট্রাইগ্লিসেরাইড। এই উপাদানগুলো রক্তের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে থাকে।
যদি কোনো কারণে যে কোনো একটি উপাদান বেশি অথবা কম হয় তখনই তাকে বলে ডিসলিপিডেমিয়া। মোটা মানুষের শরীরে চর্বি বা মেদ বেশি এটি সত্য। তাই বলে মোটা হলেই যে তার শরীরে লিপিড বেশি থাকবে এটি ঠিক নয়। পক্ষান্তরে স্বাভাবিকের তুলনায় কম ওজনের মানুষ ডিসলিপিডেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। অথাৎ লিপিডের পরিমাণ বেশি থাকতে পারে। অনেকের চোখের উপরের পাতার বা নিচের পাতায় চর্বি জমে ফুলে থাকে- এটিকে জ্যানথেল অ্যাজমা বলা হয়। রক্ত পরীক্ষা করলে তাদের রক্তে অনেক সময় কলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি পাওয়া যায়।
কারণঃ
ডিসলিপিডেমিয়ার সঠিক কারণ আজও জানা যায়নি। তবে জেনেটিক, বংশগত বা পারিবারিক কারণে রক্তে লিপিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। কিছু রোগের কারণে যেমন-হাইপোথাইরয়ডিজম, কুশিং সিন্ডম, লিভার ও কিডনির বেশ কিছু রোগ, ডায়াবেটিস, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন, জন্ম বিরতিকরণ পিল সেবন, হরমোন থেরাপি, বেশি ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য, চর্বিদার খাদ্য, লাল মাংস (গরু, খাসি, হরিণ, ভেড়া, মহিষ), মদ্যপান, সফট ড্রিংকস, শর্করা জাতীয় খাদ্য, ভাত, আলু ইত্যাদি বেশি খাওয়া হলে রক্তে লিপিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। এছাড়াও বিষণ্ণতা প্রতিরোধী ওষুধ, মানসিক রোগের ওষুধ সেবনের কারণে, সর্বোপরি অকর্মণ্য জীবনযাপন, বসে শুয়ে থাকার কারণেও ডিসলিপিডেমিয়া হতে পারে। ভাত আলু ট্রাইগ্লিসেরাইড বৃদ্ধি করে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে- যুক্তরাজ্যে খাদ্য তালিকায় শর্করা ৪৮ ভাগ, আমিষ ১৭ ভাগ এবং চর্বি ৩৫ ভাগ। এশিয়ার দেশগুলোতে খাদ্য তালিকায় শর্করা ৭৫ ভাগ, আমিষ ১০ ভাগ, চর্বি ১৫ ভাগ সেবন করা হয়ে থাকে। আদর্শ খাদ্য তালিকায় শর্করা ৫০ ভাগ, আমিষ ১৭ ভাগ এবং চর্বি ৩৩ ভাগ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
পশ্চিমাবিশ্বে বা উন্নত বিশ্বে ওবেসিটি অর্থ সমস্ত শরীরই ফুলে যাওয়া। আমাদের দেশে ওবেসিটি অর্থ পেট মোটা হয়ে যাওয়া। এটিকে সেন্ট্রাল ওবেসিটি বলা হয়। যা সুস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। আমাদের দেশে এর মূল কারণ শকর্রা জাতীয় খাদ্য বেশি খাওয়া।
জটিলতা:
ডিসলিপিডেমিয়ার ক্ষতিকারক দিকগুলো হচ্ছে স্ট্রোক (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ), উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, করনারি হার্ট ডিজিজ (হৃদরোগ), অ্যাকুউট এমআই বা হার্ট অ্যাটাক, অগ্নাশয়ের প্রদাহ, পিত্ত পাথর, শরীর ব্যথা, কোমর ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। মহিলাদের ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্ব, অনিয়মিত ঋতুস্রাব। লিপিড রক্তনালীর মধ্যে জমা হয়ে রক্তনালী সরু করার কারণে রক্ত চলাচল বাধা প্রাপ্ত হয়ে যে রোগের সৃষ্টি করে তার নাম পেরিফেরাল ভাসুকলার ডিজিজ। এটিও ডিসলিপিডেমিয়ার কারণে হয়ে থাকে।
চর্বি বা ফ্যাটকে মেডিকেল পরিভাষায় লিপিড বলা হয়। রক্তে লিপিডের সমতার ব্যতয় হলে তখন সেটিকে ডিসলিপিডেমিয়া বলা হয়।
২০১১-১২ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষের মধ্যে একটি জরিপ কাজ পরিচালনা করা হয়েছিল। এদের ৬৩৭০৮ জনের মধ্যে ১১৭০ জনের ডিসলিপিডেমিয়া পাওয়া গিয়েছিল। অতি ঝুঁকিতে ছিল পুরুষ ৬০%, মহিলা ৪০%। অল্প ঝুঁকিতে ছিল পুরুষ ৪৪%, মহিলা ৫৬%। রোগগ্রস্ত মোটা ছিল পুরুষ ৩৯% এবং মহিলা ২১%।
চিকিৎসা : জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং খাবারে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যারা ওজনাধিক্যে ভুগছেন তাদের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। লাল মাংস বর্জন করতে হবে। চর্বিদার খাবার, ফাস্টফুড, সফটড্রিংকস, কোমল পানীয় খাওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। ভাত, আলুর পরিবর্তে যব, গম, ভুট্টার তৈরি খাদ্য খেতে হবে। শাক-সবজি, ফলমূল, আঁশযুক্ত খাদ্য বেশি খেতে হবে। প্রতিদিন সকালে/বিকালে আধা ঘণ্টা হাঁটতে হবে। শরীর থেকে ঘাম ঝড়াতে হবে, শারীরিক ও কায়িক পরিশ্রম বেশি করতে হবে। অলস এবং অকর্মণ্য জীবনযাপন না করাই শ্রেয়। রোগ নির্ণয় পূর্বক চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। যাদের রক্তে কলেস্টেরল বেশি তাদের স্টেটিন এবং যাদের রক্তে টিজি বেশি তাদের ফেনফিব্রেট সেবন করতে হবে। নিয়মিত, পরিমিত এবং দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের ওষুধ যারা নিয়মিত সেবন করছেন, তাদের যদি রক্তের কলেস্টেরল স্বাভাবিক থাকে তাদেরও সাধারণত সারা জীবনের জন্য স্টেটিন বাড়তি সেবন করতে হয়। তবে এই ওষুধ অবশ্যই একজন রেজিস্ট্রার চিকিৎসকের পরামর্শে করা উচিৎ।
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের ওষুধ যারা নিয়মিত সেবন করছেন, তাদের যদি রক্তের কলেস্টেরল স্বাভাবিক থাকে তাদেরও সাধারণত সারা জীবনের জন্য স্টেটিন বাড়তি সেবন করতে হয়। তবে এই ওষুধ অবশ্যই একজন রেজিস্ট্রার চিকিৎসকের পরামর্শে সেবন করা উচিত। কারণ এই ওষুধের বেশ কিছু পার্শ^ প্রতিক্রিয়া আছে। সে কারণে ডোজ বা মাত্রা একজন চিকিৎসকই নির্ধারণ করবেন। মনে রাখবেন প্রতিটি ওষুধের সঠিক মাত্রায় সেবনের মাধ্যমেই এটি শরীরে কাজে আসবে না কি তা বিষযুক্ত হবে তা নির্ধারিত হয়।
প্রতিদিন খেতে অভ্যাস করুন : আঁশযুক্ত খাবার, টাটকা শাক সবজি, ফলমূল, কলা, লেবু, শিম ও শিম জাতীয় খাদ্য, টমেটো, শসা, পেঁয়াজ, রসুন, কালোজিরা, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি।
আপনি অসুস্থ নন তার মানে এই নয় যে, আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, শ্বাস-কাশ ও ক্যান্সার, কিডনিরোগ, ডিসলিপিডেমিয়া, এইডস এই রোগসমূহ বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর প্রধান কারণ।
ডা. রফিক আহমেদ
লেখক : সহকারী অধ্যাপক,
বক্ষব্যাধি, মেডিসিন বিভাগ,
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন