সক্রেটিস এর জীবনী
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রিসের এথেন্স নগরীতে এলোপাকি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এ মহান দার্শনিকের সম্পর্কে তথ্য লিখিতভাবে পাওয়া যায় কেবল মাত্র তার শিষ্য প্লেটোর রচনা থেকে। তৎকালীন শাসকদের কোপানলে পড়ে তাকে হেমলক বিষ পানে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।
তাকে পশ্চিমা দর্শনের ভিত্তি স্থাপনকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি এমন এক দার্শনিক চিন্তাধারা জন্ম দিয়েছেন যা দীর্ঘ ২০০০ বছর ধরে পশ্চিমা সংস্কৃতি, দর্শন ও সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছে। সক্রেটিস ছিলেন এক মহান সাধারণ শিক্ষক, যিনি কেবল শিষ্য গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানে বিশ্বাসী ছিলেন না। তার কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষায়তন ছিল না। যেখানেই যাকে পেতেন, তাকেই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর বোঝানোর চেষ্টা করতেন।
অনেকের ব্যক্তিগত ক্রোধ ছিল সক্রেটিসের ওপর। অনেকের জ্ঞানের অহংকার সক্রেটিসের কাছে চূর্ণ হয়েছিল। সক্রেটিস প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করতেন, ‘আমার কোনো জ্ঞান নেই। আমি কিছুই না।’
সক্রেটিস দার্শনিক জেনোর মতো দ্বান্দিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। এই পদ্ধতিতে প্রথমে প্রতিপক্ষের মত স্বীকার করে নেওয়া হয়। এরপর যুক্তির মাধ্যমে সেই মতকে খন্ডন করা হয়। এ পদ্ধতির একটি প্রধান বাহন হলো প্রশ্ন–উত্তর। সক্রেটিস প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমেই দার্শনিক আলোচনা চালিয়ে যেতেন। প্রথমে প্রতিপক্ষের জন্য যুক্তির ফাঁদ পাততেন ও একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকতেন। যতক্ষণ না প্রতিপক্ষ পরাজিত হয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে নেয় ততক্ষণ প্রশ্ন চলতেই থাকত। সক্রেটিসের এই পদ্ধতির অপর নাম সক্রেটিসের শ্লেষ (ঝড়পৎধঃরপ রৎড়হু)। ঞযরহশ উববঢ়বৎ– এই ছিল সক্রেটিসের প্রধানতম বাণী।
প্লেটোর বর্ণনামতে সক্রেটিসের বাবার নাম সফ্রোনিস্কাস এবং মায়ের নাম ফিনারিটি। সক্রেটিসের মা একজন ধাত্রী ছিলেন। সক্রেটিসের স্ত্রীর নাম জানথিপি, তিনি সক্রেটিসের থেকে অনেক কম বয়সী ছিলেন। সংসার জীবনে তাদের তিন পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। যাদের নাম ছিল লামপ্রোক্লিস, সফ্রোনিস্কাস ও মেনেজেনাস। অনেকেই বলেন, সক্রেটিসের স্ত্রী জানথিপি খুব বদমেজাজি ছিলেন। তবে সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড কার্যকরের সময় স্বামীর প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা সবাই বুঝতে পারে। সক্রেটিস তার শাস্তি কার্যকর হওয়ার আগে পালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ ফিরিয়ে দেন। এরপর নিজ পুত্রদের ত্যাগ করার জন্য সক্রেটিসের বন্ধু ক্রিটো তার সমালোচনা করেছিলেন।
সক্রেটিস নিজে গরিবের গরিব কিন্তু সারাজীবন সবাইকে বিনা পয়সায় শিক্ষা দিতেন। এত বড় পন্ডিত, কিন্তু তার মধ্যে অহংকারের লেশমাত্র ছিল না। কেউ তাকে রাগ করে কথা বলতে শোনেনি। শত্রু–মিত্র সবার জন্য তার মুখে হাসি লেগে থাকত। কেউ কড়া কথা বললে বা মিথ্যা গালাগালি করলেও তিনি তাতে বিরক্ত হতেন না। অনেক খারাপ লোকও তার উপদেশ শুনে ভালো পথে ফিরেছে। তার মুখের একটি কথায় অনেক অন্যায়–অত্যাচার থেমে যেত। বিপদের সময় দূর–দূরান্ত থেকে লোকজন তার পরামর্শ শোনার জন্য ছুটে যেত। ‘যা ন্যায় বুঝিব, তাই করিব’ এ কথাই তার মুখে শোভা পেত; কারণ তার কথা ও কাজের সবসময় মিল থাকত। এমন সাধু লোককে যে সবাই ভালোবাসবে, সবাই ভক্তি করবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সক্রেটিসের শত্রুরও অভাব ছিল না। কেউ হিংসা, কেউ রাগ আবার কেউ নিজের স্বার্থের জন্য সব সময় তার ক্ষতি করার চেষ্টা করত। সক্রেটিসকে কেউ সেসব কথা বললে তিনি তা হেসে উড়িয়ে দিতেন।
সক্রেটিসের বাবা ভাস্কর ছিলেন। তার প্রথম জীবন কেটেছে ভাস্করের কাজ করেই। প্লেটোর ডায়ালগগুলোর বিভিন্ন স্থানে লেখা হয়েছে যে, সক্রেটিস কোনো এক সময় সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। প্লেটোর বর্ণনায়– সক্রেটিস তিন তিনটি অভিযানে এথেনীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। এই অভিযানগুলো সংঘটিত হয়েছিল যথাক্রমে পটিডিয়া, অ্যাম্ফিপোলিস ও ডেলিয়ামে। তিনি কখনও কোনো পেশা অবলম্বন করেননি। কারণ তিনি দর্শন সম্বন্ধে আলোচনাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন। সক্রেটিস কখনই শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ নেননি। বরঞ্চ তিনি তার দরিদ্রতার দিকে নির্দেশ করেই প্রমাণ দিতেন যে, তিনি কোনো পেশাদার শিক্ষক নন। তিনি বলতেন, ‘নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়াই আমার অভ্যাস; আর এ জন্যই এমনিতে না পেলে পয়সাকড়ি দিয়েও আমি দার্শনিক আলোচনার সাথী সংগ্রহ করতাম।’
এথেন্সের তিনজন খ্যাতিমান পুরুষ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। অভিযোগকারীরা ছিলেন মেলেটাস, লাইকন ও এনিটাস। মেলেটাস ছিলেন মধ্যম শ্রেণির কবি, লাইকন ছিলেন বক্তা ও এনিটাস একজন গণতান্ত্রিক নেতা।
বাংলায় জীবনী
উত্তরমুছুন