বায়োস্কোপ.....
‘কী চমৎকার দেখা গেল এইবারেতে আইসা গেল, ঢাকার শহর দেখেন ভালো। কী চমৎকার দেখা গেল।’- এ ধারা বিবরনী বায়োস্কোপওয়ালার। এ বায়োস্কোপ বাংলার হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্যের নাম। কাঠের বাক্সে চোখ লাগিয়ে গানের তালে ছবি দেখার দৃশ্য নগরজীবনে আর চোখেই পড়ে না।
বায়োস্কোপ দেখাতে রাজশাহী থেকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত মাসব্যাপী কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে এসেছেন আব্দুল জলিল মন্ডল। খঞ্জনী আর গানের তালে বাক্সেও ভেতর পাল্টে যায় ছবি। আর তা দেখে যেন গল্পের জগতে হারিয়ে যায় ছেলে বুড়ো সবাই।
বর্তমান সময়ে গ্রাম বাংলায় বায়োস্কোপ এমনই বিরল যে, যাদুঘরে রেখে দেয়ার জন্যও অন্তত একটি বায়োস্কোপ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সোনারগাঁওয়ে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে সুদূর রাজশাহী থেকে বায়োস্কোপ দেখিয়ে অর্থ উপার্জনের আশায় এসেছেন জলিল মন্ডল। কৈশোর হৃদয় চুরি করে হারিয়ে যাওয়া এই হঠাৎ খুঁজে পাওয়া বায়োস্কোপ এ কারুশিল্প ও লোকজ উৎসবে। এ মেলায় আসলে দেখতে পাবেন হারিয়ে যাওয়া বায়োস্কোপের প্রদর্শন।
বায়োস্কোপের সাথে বাঙালিকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। বিশেষ করে গ্রাম বাংলার জনপদে বেড়ে উঠা মানুষকেতো বটেই। তবে যারা শহরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি জীবন যাপন করে অভ্যস্থ কিংবা যাদের জন্ম এই মাত্র একযুগ আগে তাদের কাছে হয়তো হাস্যকর এক বোকা বাক্সো মনে হবে।
কিন্তু বায়োস্কোপ মোটেও হাস্যকর কোন বস্ত ছিলো না, কিংবা ছিলো না কোন বোকা বাক্সোও! প্রকৃতপক্ষে বায়োস্কোপ গ্রাম বাংলার সিনেমা হল। রঙ-বেরঙের কাপড় পরে, হাতে ঝুনঝুনি বাজিয়ে বিভিন্ন রকমের আলোচিত ধারা বর্ণনা করতে করতে ছুটে চলতো গ্রামের স্কুল কিংবা সরো রাস্তা ধরে।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো তার পেছন পেছন বিভোর স্বপ্ন নিয়ে দৌড়াতো গ্রামের ছেলে মেয়েরা। বায়োস্কোপওয়ালার এমন ছন্দময় ধারা বর্ণনায় আকর্ষিত হয়ে ঘর ছেড়ে গ্রামের নারী পুরুষ ছুটে আসতো বায়োস্কোপের কাছে। একসাথে সকলে ভিড় জমালেও তিন কি চার জনের বেশী একসাথে দেখতে না পারায় অপেক্ষা করতে হতো। সিনেমা হলের মতো এক শো এরপর আবার আর তিন বা চারজন নিয়ে শুরু হতো বায়োস্কোপ।
বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করলেই ‘কি চমৎকার দেখা গেলো’ বলে ফের শুরু হতো বায়োস্কোপওয়ালার ধারা বিবরণী। আর এই বায়োস্কোপ দেখানোর বিনিময়ে দু’মুঠো চাল কিংবা ২টাকা নিয়েই মহা খুশি হয়ে ফিরে যেতো বায়োস্কোপওয়ালা। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে বাংলার বিনোদনের এই লোকজ মাধ্যমটি। টিভি আর আকাশ সংস্কৃতি স্যাটেলাইটের সহজলভ্যতার কারণে আপনা আপনিই উঠে গেছে বায়োস্কোপ। তবুও কোথাও না কোথাও একজন থাকে। তেমনি একজন আব্দুল জলিল মন্ডল।
রাজশাহী জেলার বাঘমারা থানার চায়ের শারা গ্রামের মৃত বকশি মন্ডলের ছেলে জলিল মন্ডল। বাবা বকশি মন্ডল দীর্ঘ ৪৩ বছর এ পেশায় জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে বাবার উত্তরসূরী হিসেবে ১০-১২ বছর বয়সে জলিল মন্ডল এ পেশায় আসেন। এরই মধ্যে এ পেশায় দীর্ঘ ৩২ বছর পার করে দিয়েছেন তিনি। এ পেশার আয় রোজগার দিয়েই ২ মেয়ে, ১ ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে কোন রকমে তার দিন চলে যাচ্ছে।
বায়োস্কোপ পেশায় তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেন। একটা সময় ছিল যখন গ্রাম, গঞ্জের পথে ঘাটে হাট বাজারে তিনি ও তার বাবা বায়োস্কোপ দেখিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। তখন ধান, চাল ও অর্থের বিনিময়ে বায়োস্কোপ প্রদর্শন হত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন