সফল উদ্যোক্তা মোস্তফা কামাল মেঘনা গ্রুপের না বলা গল্প ......!!!
একটি বাইসাইকেল কেনার সামর্থ ছিল না যাঁর, তার প্রতিষ্ঠানে এখন আড়াই হাজারের বেশি গাড়ি শুধু পণ্য আনা-নেওয়া করে। রয়েছে এক ডজন আন্তর্জাতিক জাহাজসহ ১০০টি অভ্যন্তরীণ জাহাজ। যে মোস্তফা কামাল একসময় গুলিস্তান আর পুরান ঢাকার অলিগলিতে পণ্য ফেরি করেছেন, কোনো ডিলার পাননি, কোনো এজেন্ট পাননি; সেই মোস্তফা কামালের প্রতিষ্ঠানের ডিলারশিপ নেওয়ার জন্য এখন হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে অনুরোধ আসে। মাত্র ১৭৫ টাকা নিয়ে যে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তার বার্ষিক টার্নওভার এখন দুই বিলিয়ন মারকিন ডলারেও বেশি।
যাত্রাবাড়ির লজিংয়ে থেকে ৪ আনা দিয়ে বাসে করে গুলিস্তান এসে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে মৌলভীবাজারে হাজী মোহাম্মদ হোসেনের দোকানে পৌঁছা এবং সারাদিনের কাজ শেষে একই পথে ফিরে যাওয়া। বিনিময়ে মাস শেষে সর্বসাকুল্যে ১৭৫ টাকা। এই ছিল মোস্তফা কামালের প্রথম আনুষ্ঠানিক কর্মজীবন। আমাদের অনেকের কাছেই তাঁর ওই বেতনের এ পরিমাণকে আপাতদৃষ্টে সামান্য মনে হতে পারে। কিন্তু বেতন সামান্য হলেও সেখানে কাজ করে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যে পুঁজি তিনি সংগ্রহ করেন, আজকের ২ বিলিয়ন ডলারের টার্নওভার সে পুঁজিরই ক্রমপুঞ্জিত রূপান্তর নয় কি?
তাঁর অভিজ্ঞতার বিবরণ শোনার জন্য বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
তাঁর উদ্যোক্তা হওয়ার পথে রয়েছে হাজারো কষ্টের গল্প। সেরকমই এক কষ্টের অধ্যায়ের নাম ১৬ কেজি তেলের ক্যান মাথায় করে বহন করা। মোস্তফা কামাল বলেন, তাঁর জন্ম ভারত সীমান্তের কাছাকাছি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সীমানাপ্রাচীর টপকিয়ে ভারতে যেতেন এবং সেখান থেকে ভোজ্য তেলের ক্যান কিনে বাংলাদেশে এনে বিক্রি করতেন। এই পুরোটা পথ, মাইলের পর মাইল ১৬ কেজি ওজনের তেলের ক্যান মাথায় করে বহন করতেন মোস্তফা কামাল। পরে মোস্তফা কামালের মা বিষয়টি জানতে পেরে তাঁকে এ কাজ থেকে নিবৃত্ত করেন। কিন্তু রক্তের মধ্যে যার ব্যবসায়ী হওয়ার নেশা, তিনি কেন বসে থাকবেন। ঠিকই ঢাকায় এসে আবার সেই কষ্টকর, দুর্গম পথ বেছে নেন।
উদ্যোক্তা হওয়ার পথে পা বাড়িয়ে দেখলেন, এ পথে বিস্তর কাঁটা। পদে পদে বাধা। ১৯৮২ সালে প্রথমবারের মতো পামওয়েল আমদানী করেন। কিন্তু সেই তেলের মান সামান্য খারাপ ছিল, নতুন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি যেটা বুঝতেই পারেননি। ফল হলো ভয়াবহ। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাস করতে পারেন না। এভাবে প্রায় দুই বছর ধরে তেলের ড্রামগুলো পড়ে থাকল বন্দরে। মোস্তফা কামাল প্রায় পথে বসে গেলেন।
ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ভাবলেন, পরিবহণ ব্যবসায় নামবেন। অনেক ভেবে চিন্তে গুলিস্তান থেকে মিরপুর-১১ নম্বর রুটে একটি ভক্স ওয়াগন গাড়ি নামালেন। কিন্তু বেশিদিন চালাতে পারলেন না। ড্রাইভার, হেলপারদের দৌরাত্মে পরাজিত হয়ে ব্যবসায় লস করলেন। কিন্তু হাল ছাড়ার মানুষ তো তিনি নন। তাই ঝুঁকলেন শিল্প প্রতিষ্ঠার দিকে।
অতঃপর শিল্পের পথে যাত্রা
১৯৭৬ সালে ট্রেডিং কোম্পানি হিসেবে ক্ষুদ্র পরিসরে যাত্রা শুরু করেছিল মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্ট্রিজ। এরপর ১৯৮৯ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন মেঘনা ভেজিটেবল ওয়েল ইন্ডাস্ট্রি। ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকেন ব্যবসার পরিধি। চাল, ডাল, তেল, চিনি, লবন, আটা, ময়দা, সুজি থেকে শুরু করে নানা ধরণের খাদ্য পণ্য, রাসায়নিক পদার্থ, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, বিদ্যুৎ প্লান্টসহ ৪০টির বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
দেশের প্রথম অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাঃ------
বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি উদ্যেগে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছেন মোস্তফা কামাল। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইতিমধ্যে পাঁচটি ইন্ডাস্ট্রি পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে। দেশ পেরিয়ে বিদেশে যাচ্ছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পণ্য। এ মুহূর্তে বিশ্বের ১১টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে মেঘনার ব্র্যান্ড ‘ফ্রেস’ পণ্য।
নিজস্ব বিদ্যুৎ প্ল্যান্টঃ-----
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের রয়েছে নিজস্ব বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট। এই প্ল্যান্ট থেকে প্রতিদিন ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এরমধ্যে নিজের কারখানার প্রয়োজন মিটিয়ে ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরকারের কাছে বিক্রি করে মেঘনা গ্রুপের পাওয়ার প্ল্যান্ট।
মোস্তফা কামালের সামাজিক দায়বদ্ধতাঃ----
সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাকে কখনোই ভুলে থাকেন না মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, কুমিল্লায় নিজের এলাকায় গরীব-দুঃখী মানুষেদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ, আর্থিক সহযোগিতাসহ নানা ধরনের মানবহিতৈষী কাজ করতেন। একদিন মোস্তফা কামালের বাবা বললেন, মানুষকে শিক্ষিত করার কাজে তোমার কিছু অর্থ ব্যয় করো। বাবার কথাকে শিরোধার্য মেনে নিয়ে তিনি শিক্ষা প্রসারে কাজ শুরু করেন। কুমিল্লার নিজ এলাকায় বাবার নামে কলেজ, মায়ের নামে মাদ্রাসাসহ বেশ কিয়েকটি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তরুণদের উদ্দেশে যা বললেনঃ----
কাজ করার ইচ্ছাই প্রধান উল্লেখ করে দেশ বরেণ্য এই উদ্যোক্তা বলেন, উদ্যোক্তা হতে হলে প্রবল ইচ্ছা শক্তি থাকতে হবে ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন